বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল যেসব ঘটনা

1900-1947

[শব্দ সংখ্যা ৩৫০০; ছবির সংখ্যা ৩০; পড়তে সময় লাগবে ১৫ মিনিট]

বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ট ঘটনা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হঠাৎ করে আসেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে যেসব ঘটনা বাঙালি জাতির এই মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল তা না জানলে এই সিরিজটি অপূর্ণ থেকে যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান লোকসংখ্যার ৭০ ভাগ মানুষের জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার পর। তাই পাকিস্তানের ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলী সংক্ষেপে এই পর্বে তুলে ধরলাম।

১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ – পাকিস্তান নামের আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম

ভারতে ব্রিটেনের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে এক বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের ভারতবর্ষ বিভক্তির পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগসহ সব দলের নেতৃবৃন্দ পরিকল্পনা মেনে নেন। এভাবে দীর্ঘ দু’শো বছর ইংরেজ শাসন ও শোষণের পর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় যার অধীনে ছিল পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ। দেশ ভাগের সময় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা অঞ্চলকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। কলকাতাসহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারতের অধীনে এবং ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যাবধান থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অসম রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তান নামের এই নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষী নেতা। সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাদের কোন সহানুভূতি ছিল না। মুসলিম লীগের প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ১৭ই অগাস্ট পাকিস্তানের করাচিতে গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ নেন।

৪ঠা জানুয়ারি, ১৯৪৮ সাল – ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা

৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পূর্ব পাকিস্তান সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়। কিন্তু পরে মুসলিম লীগের রাজনীতির বিপরীতে ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকা অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি দল গঠনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে এই নাম থেকে মুসলিম অংশটি বাদ দেয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলন।

২৪শে মার্চ, ১৯৪৮ সাল – পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ অনুষ্ঠানে জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে কার্জন হলে উপস্থিত ছাত্রদের একটি অংশ তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়।

২৩ শে জুন, ১৯৪৯ সাল – আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা

ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

১৮ই আগষ্ট, ১৯৪৯ – নানকার বিদ্রোহ

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার সানেশ্বর উলুউরি গ্রামের সুনাই নদীর তীরে ঘৃন্য নানকার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ( [link|https://bn.wikipedia.org/s/32v1|নানকার বিদ্রোহ]) নানকারদের উপর পাকিস্থানী মুসলিমলীগ সরকারের ইপিআর, পুলিশ এবং জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী সঙ্গবদ্ধ হয়ে সশ্রস্ত্র হামলা চালালে ৬ জন নানকার নিহত হন। নানকার বিদ্রোহ সিলেট অঞ্চলের একটি কৃষক-আন্দোলন, যা ১৮ আগস্ট ১৯৪৯ সালে সংগঠিত হয়। বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত করার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ – ভাষা আন্দোলন

ছাত্ররা বাংলা ভাষার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করার পর ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। পরে সমবেত ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অমান্য করে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করে; ঘটনাস্থলে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল জব্বার- তিনজন মারা যান। হাসপাতালে মারা যান আব্দুস সালাম। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

পরের বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ সালে হাজারো মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সরকার এইদিন সব সভা সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। এইদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শোকের প্রতীক হিসাবে কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন ঢাকার অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। এরপর থেকে বাঙালি জাতি প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে শহীদ দিবস পালন করে আসছে।

১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই – যুক্তফ্রন্ট গঠন

১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) গঠন করেন। এ কে ফজলুল হককে সভাপতি এবং আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সম্পাদক করে কেএসপি গঠিত হয়। মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম খেলাফতে রাব্বানী পার্টি গঠন করেন। এ ছাড়া ছিল কংগ্রেস, তফসিলি ফেডারেশন, সোশ্যালিস্ট পার্টি ও গণতন্ত্রী দল। মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৪৮ সালে বেআইনি ঘোষণা করে। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। সরকার ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতারা দুই ধরনের মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ছোট পক্ষ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ঐক্যবদ্ধ মোর্চায় নির্বাচন করতে চান। অন্যরা মনে করেন আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে। মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে না থাকলেও ছাত্রসমাজের চাপে আওয়ামী মুসলিম লীগসহ সব বিরোধী দল একত্র হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন।

১০ই মার্চ, ১৯৫৪ – পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচনী জোট যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের ওপর মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ২১-দফার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। সেইসাথে আরো ঘোষণা কর হয় যে, কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।
যুক্তফ্রন্টের উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি:

  1. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
  2. বিচার বিভাগকে শাসন-বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে।
  3. দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে।
  4. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে।
  5. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।
  6. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ, পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইব।

১৯৫৪ সালে মার্চের ৮-১২ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে মোট আসন ছিল ৩০৯ টি। এর মধ্যে মুসলিম আসন ছিল ২৩৭ টি। এর মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন, যুক্তফ্রন্ট ২১৫টি আসন, খেলাফতে রব্বানী ১টি আসন ও বাকীগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতে নেয়। পরবর্তীতে স্বতন্ত্রদের একজন মুসলিম লীগে ও আটজন যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। ফলে মুসলিম লীগের জয়ী আসন হয় ১০টি আর যুক্তফ্রন্টের জয়ী আসন হয় ২২৩টি। শেরেবাংলা যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হন। ৩রাা এপ্রিল, ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার গ্রহণ করে। মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে যুক্তফ্রন্টে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হক চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।

৩০শে মে, ১৯৫৪ – যুক্তফ্রন্টের সরকার মন্ত্রীসভা বাতিল

মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরুর আগে অবাঙালিদের ষড়যন্ত্রে আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও অবাঙ্গালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গায় ১ হাজার ৫০০ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে জানা যায়, সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে এই দাঙ্গা শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘এই দাঙ্গা যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অদক্ষতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই। ষড়যন্ত্র করাচি থেকে করা হয়েছে।’ তাছাড়া এক বছর পার হতে না হতেই ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, সমঝোতাহীনতা, মতানৈক্য এবং বহুমুখি দলীয় কর্মসূচির কারণে যুক্তফ্রন্টের ঐক্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। মতবিরোধের কারণে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। যদিও তা পার্লামেন্টে পাশ হয়নি। নির্বাচনী জোট যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সদস্যদের একটি বড় অংশ ছিল নবাগত, তুলনামূলকভাবে তরুণ এবং তাদের সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।
এ সময় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে ওই পত্রিকার সাংবাদিক কালাহান লিখেছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বলেছেন, বাংলাকে স্বাধীন করা তাঁর প্রথম কাজ।’ এবার মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতারা মোক্ষম সুযোগ খুঁজে পেলেন। এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে দেশদ্রোহের অভিযোগে মন্ত্রীসভা গঠনের মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে বরখাস্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়।

যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিকদের অনৈক্য ও দলাদলিতে সাধারণ মানুষ এদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী দেশের বাইরে, শেখ মুজিব কারাগারে, কোনো প্রতিবাদ হলো না। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যতই হইচই বাঙালিরা করুক না কেন, তাদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। বন্দুক, লাঠি দেখলে তারা গর্তে ঢুকবে। এ সময় যদি বাধা পেত, তবে হাজারবার চিন্তা করত বাঙালিদের ওপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে। যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির কাপুরুষতা দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এই দিন থেকে বাঙালীদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজ করতে নামতে নেই, তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশ বেশি হয়।’

যাইহোক, পাকিস্তানের প্রাথমিক পর্বে পূর্ববাংলার শাসনক্ষমতায় স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও বাঙালিরা ভূমিকা রাখার যে সুযোগ পেয়েছিল সে অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে পূর্ব বাংলার নেতা-কর্মীদের কাজে আসে।

১৯৫৪ সালের ১৯ অক্টোবর – আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ

বগুড়ার জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগের কনভেনশনে দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে ’আওয়ামী লীগ’ করা হয়। এ পরিবর্তন দলটির পাকিস্তানি মুসলিম জাতীয়তাবাদী নীতি পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী নীতি অনুসরণের ইঙ্গিত বহন করে।

৩রা ডিসেম্বর, ১৯৫৫ – ঢাকায় বাংলা একাডেমী স্থাপন

৭ই মে, ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হয়। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অন্যতম দাবি ছিল বাংলা ভাষার প্রসার ও গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র একাডেমি স্থাপন করা। অবশেষে ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলা একাডেমী।

২৭ অক্টোবর, ১৯৫৮ – জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্যাকে উৎখাত করে সামরিক আইন জারী করেন। সামরিক আইনে সকল নির্বাচনী ব্যবস্থা বিলুপ্ত ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় এবং প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনে প্রতিযোগিতার অযোগ্য ঘোষণা করে একাধিক সামরিক বিধিনিষেধ জারি করা হয়।

১৯৬২ সাল – সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব গ্রেফতার

জানুয়ারি মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ এবং জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নেতা-কর্মীকে বন্দী করা হয়।

১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ – বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যা ১৯৬২ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু বৈষম্যমূলক বলে ওই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪৪ ধারার মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বর পূর্বপাকিস্তানে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। এইদিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সমাবেশ শেষে কার্জন হল থেকে বিক্ষুব্ধ মিছিল বের হয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় ব্যবসায়ী, কর্মচারী, রিকশা শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এমন সংবাদ পেয়ে মিছিল নবাবপুরের দিকে যাত্রা করলে হাইকোর্টের সামনে পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ঘটনাস্থলে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহ পরদিন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ছাত্র অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনে আইয়ুব খান সরকার শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত করে।

২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩ – কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধন

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের উপরে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অনেকেই শহীদ হয়েছিলেন। তাদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রাঙ্গণে একাধিক ব্যক্তির উদ্যোগে কয়েকবার অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান। ১৯৫৭ সালে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে চূড়ান্ত নকশা তৈরি করে শুরু করা হয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ। এরপর ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন।

৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ – ৬ দফা দাবি উপস্থাপন

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতৃবর্গ লাহোরে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দলের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ওই কনভেনশনে যোগদান করেন এবং এ সম্মেলনের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁর যুগান্তকারী ৬-দফা দাবি উপস্থাপন করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো ৬-দফা ফর্মূলাকে একটি উদ্ভট প্রস্তাব বলে প্রত্যাখ্যান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় ৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে বৈরী লেখালেখি হয় এবং শেখ মুজিবকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে তুলে ধরা হয়। শেখ মুজিব সম্মেলন বয়কট করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের সামনে ছয় দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন। ১৮ এপ্রিল ৬-দফা সনদের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জন-প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমাবার লক্ষ্যে জরুরি বিধিবলে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।

৩রা জানুয়ারি, ১৯৬৮ – আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মরত ও প্রাক্তন সদস্য, ব্যবসায়ী এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য” নামের এই মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৩৫ জন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা ভারত সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই মামলার বিচার প্রক্রিয়ায়, প্রথমে আসামিদেরকে ‘দেশরক্ষা আইন’ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ‘আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। একই সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনও শুরু হয়।

১৯৬৯ : গণআন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার

ইতোমধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের শুরুতে পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গণআন্দোলন কার্যত একটি গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা সনদ ঘোষণা করে যার লক্ষ্য ছিল কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কতিপয় শ্লোগানের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সুস্পষ্ট করেছিল। যেমন, ‘জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। ছাত্ররা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতও নির্বাচন করেন। তাঁদের জাগরণী শ্লোগান ছিল ‘জয়বাংলা’।

  • ২০শে জানুয়ারি, ১৯৬৯ – পুলিশের গুলিতে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ মৃত্যুবরণ করেন। সহযোদ্ধারা আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করে। পরে শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলে আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদগেট নামকরণ করা হয়।
  • ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ – আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দি থাকা অবস্থায় ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী একজন সৈনিকের ছোড়া রাইফেলের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
  • ২২ ফেব্রুয়ারি দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে গণদাবির নিকট মাথা নত করে।
  • ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সংবর্ধনা। শেখ মুজিবকে স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে সমবেত জনতা জনসমুদ্রের রূপ নেয়। সভার সভাপতি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করার প্রস্তাব করলে হর্ষোৎফুলল জনতা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় তা সমর্থন করে। শেখ মুজিব দেশবাসী ও ‘বিপ্লবী জনতার’ প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন।
  • ১০ মার্চ সরকার আয়োজিত রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ফেডারেল ব্যবস্থা ৬-দফা ফর্মূলা পেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা এ ৬-দফা ফর্মূলাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য একটি ছদ্মকৌশল বলে আখ্যায়িত করেন।
  • ২৫ মার্চ গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় এবং আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতে থাকায় ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান পদত্যাগ করে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সামরিক আইন জারী করা হয়। জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইয়াহিয়া খান একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেন।

১২ই নভেম্বর, ১৯৭০ – ভোলা সাইক্লোন

ইতিহাসের অন্যতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভোলার সাইক্লোনকে মোটেও গুরুত্ব দেননি। যার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তানের শাসকের ওপর নাখোশ হয় যা পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল।

৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ – সাধারণ নির্বাচন

১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর রেডিও পাকিস্তান বেতারযোগে নির্বাচনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছয়দফা ভিত্তিক ফেডারেল ব্যবস্থার ধারণাটি নতুন করে উত্থাপন করেন এবং সবাইকে তাঁর ধারণাটি গ্রহণ করতে এবং ৬-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাঁকে সহযোগিতা করার আহবান জানান। ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানের এক জনসভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান অবাস্তব এবং লক্ষ্যহীন হয়ে পড়েছে। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারণকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং এ ভূখন্ডকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার দাবি জানান।
২৬ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় ফিরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্নিঝড় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পাকিস্তান সরকারের চরম ব্যর্থতা তুলে ধরেন এবং পরিশেষে ঘোষণা করেন যে, এটা যত না ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যর্থতা তার চাইতে বড় ব্যর্থতা খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, পূর্ব-পাকিস্তানকে সম্ভব হলে ব্যালটের মাধ্যমে এবং প্রয়োজন হলে বুলেটের দ্বারা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে হবে।

৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনগণ ৬-দফা এবং ১১-দফা কর্মসুচির সমর্থনে ভোট দান করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে এবং জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। তৎসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ অথবা পাকিস্তান পিপলস পার্টি এদের কেউই নিজেদের প্রদেশের বাইরে একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারে নি। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের দুই প্রদেশ রাজনৈতিক দিক থেকে একে অপর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

১লা মার্চ, ১৯৭১ – জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত

আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে-কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা।

  • ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ৬-দফা এবং ১১-দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে সকল নির্বাচিত প্রতিনিধি রমনায় মিলিত হন। বঙ্গবন্ধু এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
  • ১২-১৩ জানুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন এবং শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
  • ২৭-২৮ জানুয়ারি ভূট্টো তাঁর প্রধান সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং ক্ষমতা ভাগবণ্টনের ব্যাপারে শেখ মুজিব এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন। এসব আলাপ আলোচনা থেকে ইতিবাচক কোনো ফল বেরিয়ে আসেনি।
  • ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হবে ৩ মার্চ।
  • ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, ৬-দফা ইস্যুতে পূর্বাহ্নে একটি সমঝোতায় উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর দল ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না।
  • ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ মিনার থেকে ঘোষণা দেন যে, বাঙালির অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধে যেকোন চক্রান্তের মোকাবিলার জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
  • ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে মিলিটারি জেনারেলদের সাথে আলোচনায় বসেন এবং নিজের মতো করে সমস্যার সমাধান করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ হোটেল পূর্বানীর সামনে জমায়েত হয়। সেখানে তখন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক চলছিল। উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু জনতাকে সংযত থাকতে উপদেশ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ঘোষণা দেবেন।

২রা মার্চ, ১৯৭১ – স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন

২ মার্চ শহরের সব এলাকা এবং শহরতলি থেকে ছাত্রজনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জমায়েত হতে থাকে। জনতা স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে থাকে এবং ঐকতানে গাইতে থাকে স্বাধীনতার সঙ্গীত। ছাত্রনেতারা (নূরে আলম সিদ্দিকী, এএসএম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন) জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তারপর ছাত্রলীগ নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) সহ-সভাপতি এএসএম আবদুর রব জয়বাংলা শ্লোগান এবং তুমুল করতালির মধ্যে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বটতলায় জমায়েত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। এইদিন বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত তাঁর সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু জনতা তাঁর কাছে তাৎক্ষণিক এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার দাবি জানায়।
৪ মার্চ দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
৫ মার্চ এএসএম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং অন্যান্য ছাত্রনেতার নেতৃত্বে ছাত্ররা ঢাকায় এক লাঠি মিছিল বের করে। ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন।
৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে, ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগের মতই অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরি এবং প্রবলভাবে চালিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প ব্যক্ত করে।

৭ই মার্চ, ১৯৭১ – বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিট স্থায়ী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, সেখানেই শেখ মুজিব বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

২৫শে মার্চ, ১৯৭১ – গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’

পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার শুরু হয়েছিল ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে। ওই রাতে হামলার সামরিক নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। মধ্যরাতে ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত ঢাকাবাসী নিরস্ত্র নরনারীর উপর ঝাপিয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, তেজগাঁও বিমানবন্দর, মোহম্মদপুর, রায়েরবাজার, আজিমপুর, জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর নির্বিচার হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বন্দর শ্রমিক ও কর্মকর্তারা করাচী থেকে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে চট্টগ্রামে আগত সোয়াত জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্য চট্টগ্রামবাসী সকল প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দেন। ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা সঙ্গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।

২৬শে মার্চ, ১৯৭১ – স্বাধীনতার ঘোষণা

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে তখন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। এর আগে দুপুর বেলাতেও তিনি সেটি পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেন। পরদিন ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাতের অধিবেশনে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে লিখিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।

১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ – অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন

গণহত্যার প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ১০ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের অনেক নির্বাচিত সদস্য কোলকাতায় সমবেত হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী গণপরিষদ গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া রচনা করেন। এই গণপরিষদের উদ্যেগে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়ায় (বর্তমানে মুজিবনগর) অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার (যা মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত) গঠিত হয়। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং এম. এ. জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

মার্চ – ডিসেম্বর, ১৯৭১ – ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ

ঢাকায় গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১০ এপ্রিলের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ নিজেদের আয়ত্তে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে। যুদ্ধের প্রথম দিকে বাঙালিদের প্রতিরোধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু অসংগঠিত। অধিকাংশ বাঙালি সৈনিক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। শুরুর দিকে সেনাবাহিনী ও ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করে চট্টগ্রাম শহরের একটি বড় অংশ, কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিপুল সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মে মাসের শেষ নাগাদ অধিকাংশ মুক্তাঞ্চলের দখল নিয়ে নেয়। এই সময়ে রাজাকার, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। মূলত মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের সদস্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালি এবং দেশভাগের সময় আসা বিহারি মুসলিমদের নিয়ে এই দলগুলো গঠিত হয়। এরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও নীরিহ মানুষকে হত্যা, জুলুম ও নির্যাতন করে।

মার্চের শেষদিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘুরা বিশেষভাবে তাদের রোষের শিকার হয়। আক্রমণ থেকে বাঁচতে দলে দলে মানুষ ভারতের সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শরণার্থীদের এই স্রোত নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ অব্যাহত থাকে। জুলাই মাসেই বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ছেড়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে গেরিলা অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনীর বাঙালি সৈন্যদের দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়। অধিকাংশ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল সীমান্তের নিকটবর্তী। এগুলো পরিচালনায় ভারত প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। এই প্রশিক্ষিত গেরিলারা দেশের ভেতরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে এবং ডিসেম্বরের শুরুর দিকে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে।

৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ – মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ ও স্বীকৃতি

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটিগুলোতে অতর্কিতে হামলা চালায়। বিমানঘাঁটিতে থাকা ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলোকে ধ্বংস উদ্দেশ্য নিয়ে এই আক্রমণ চালায়। ভারত এই হামলাকে স্পষ্টত তাদের দেশের ওপর আগ্রাসন হিসেবে দেখে এবং পাল্টা হামলা চালায়। এই হামলা-পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে উভয় দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সংসদে এ ঘোষণা দেন।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ – পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিন কোর ভারতীয় সৈন্য অংশগ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর আরও প্রায় তিন ব্রিগেড সৈন্য এবং আরও অসংখ্য অনিয়মিত সেনা তাদের সহায়তা করে। এই সেনারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিন ডিভিশন সৈন্যের তুলনায় অনেক গুণ বড় ছিল। যৌথবাহিনী দ্রুত বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়তে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিগুলো দখল করে যৌথবাহিনী দ্রুত রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ঠেকাতে সীমান্তের দিকে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনারা এত দ্রুত আক্রমণ সামাল দিতে পারেনি। যৌথবাহিনীর হাতে শীঘ্রই ঢাকার পতন ঘটে এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

এভাবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ট ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ যা ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণ ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। সেইসাথে শত শত বছর বৈদেশিক শাসকদের অধীনে থাকা পূর্ববঙ্গে আবার বাঙালিদের শাসনক্ষমতা ফিরে আসে।

ছবি ও তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ – দলিল পত্র
বাঙালির ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ হাননান
বিবিসি নিউজ বাংলা বিভাগ, বাংলাপিডিয়া; উইকিপিডিয়া
বাংলাদেশের জাতীয় পত্র-পত্রিকা
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১, সম্পাদনা: প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ, মোনায়েম সরকার, ড: নুরুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।