ব্যবসায় সংগঠন

মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে গঠিত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলা হয়। ব্যাপক অর্থে বলা যায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদনের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত অভাব পূরণের লক্ষে সেগুলো বণ্টন এবং এর সহায়ক সবরকম বৈধ, ঝুঁকিবহুল ও ধারাবাহিক কার্যকে ব্যবসায় বলে। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করার পূর্বে প্রথমেই স্থির করতে হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা কোন ধরনের হবে। আমাদের দেশে নিম্নোক্ত চার ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রচলিত আছে।

  1. একমালিকানা ব্যবসায় (Sole proprietorship)
  2. অংশীদারী ব্যবসায় (Partnership)
  3. কোম্পানি (Corporation)
  4. সমবায় সমিতি (Cooperative)

একমালিকানা ব্যবসায়: এক মালিকানা ব্যবসায় হল একজন ব্যাক্তির মালিকানাধীন এবং মালিক কতৃক পরিচালিত ব্যবসা। এটি একটি সনাতন কারবার ব্যবস্থা। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এ ধরনের ব্যবসা পদ্ধতি ব্যাপকবে প্রচলিত। একমালিকানা ব্যবসার সকল দায়দায়িত্ব ও ঝুঁকি এর মালিক একাই বহন করে।এ ধরনের কারবার গঠন ও পরিচালনায় আইনের বাধ্যবাধকতা সীমিত অথবা নেই বললেও চলে। একমালিকানা কারবারে মালিক নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং নিজ তহবিল থেকেই পুঁজির সংস্থান করতে পারে। আয়কর ব্যতীত একক মালিকানাধীন কারবারের মালিককে কোনো ব্যবসায়িক কর প্রদান করতে হয় না।এরূপ কারবার ব্যবস্থায় সর্বপ্রকার ঝুঁকির ভার একজন মালিককেই বহন করতে হয়। তিনি তার মালিকানা ব্যবসায়ের সকল দায়দেনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন।কারবার দেউলিয়া হলে মালিক নিজেই দেউলিয়া হিসেবে চিহ্নিত হন এবং দায়দেনা পরিশোধের জন্য তার সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিও ব্যবহূত হয়।

অংশীদারি ব্যবসায়: ব্যাংকিং ব্যতীত অন্যান্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম ২ থেকে ২০ জন পর্যন্ত এবং ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন পর্যন্ত যৌথ মালিকের বিনিয়োগের মাধ্যমে আইনসম্মত ব্যবসায়িক সংগঠনকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে। অংশীদারদের মধ্যে শুধু চুক্তির মাধ্যমেই কারবার অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে অংশীদারি কারবার প্রতিষ্ঠার জন্য অংশীদারিত্ব আইন ১৯৩২ অনুসরণ করতে হয়। অংশীদারি ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি চুক্তি। লিখিত চুক্তিকে বলা হয় চুক্তিপত্র (deed)। অংশীদারিত্ব আইন ১৯৩২ অনুযায়ী অংশীদারি কারবারের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে নিবন্ধিত হলে তা কয়েকটি আইনি অধিকার ও সুবিধা ভোগের সুযোগ পায়। অংশীদারি ব্যবসায়ের নামের শুরুতে ‘মেসার্স’ লেখা বাধতামূলক।
বাংলাদেশে প্রচলিত অংশীদারি আইন দু ধরনের : সাধারণ অংশীদারি কারবার এবং সীমিত দায়ের অংশীদারি কারবার। সাধারণ অংশীদারি কারবারে সকল অংশীদার যৌথভাবে, বা তাদের পক্ষে তাদেরই মধ্য থেকে যে কেউ ব্যবসায় পরিচালনা করেন এবং অসীম দায়সহ সকল দায়িত্ব বহন করেন। সাধারণ অংশীদারি কারবারের দুটি ধরন হচ্ছে স্বেচ্ছায় অংশীদারিত্ব এবং নির্দিষ্ট বা বিশেষ অংশীদারিত্ব। অংশীদারি কারবারের মেয়াদ কতদিন হবে অর্থাৎ অংশীদারগণ নির্দিষ্ট কারবার প্রতিষ্ঠানে কতদিন একত্রে থাকবেন তা যদি নির্ধারিত না থাকে তাহলে সেটি হবে সাধারণ অংশীদারি কারবার। নির্দিষ্ট বা বিশেষ অংশীদারি কারবারের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের মেয়াদ নির্ধারিত থাকে অথবা কি কি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত অংশীদারিত্ব অব্যাহত থাকবে তা বলে দেওয়া থাকে। তবে পরবর্তী ক্ষেত্রে, উদ্দিষ্ট সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের পরও যদি অংশীদারি কারবারের অস্তিত্ব বজায় থাকে তাহলে তা আপনা-আপনিই স্বেচ্ছায় অংশীদারিত্বের আইনি মর্যাদা পায়। সীমিত অংশীদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৩জন অংশীদারের দায় সীমাবদ্ধ করা যায়। সীমিত অংশীদারি ব্যবসায়ের নামের শেষে ‘Ltd’ লেখা বাধ্যতামূলক। মূলধন বিনিয়োগ, পরিচালনা, লাভ-ক্ষতি বন্টন, দায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে অংশীদারি ব্যবসায়ে ৮ ধরণের অংশীদার থাকতে পারে। সাধারণ অংশীদার, সীমিত অংশীদার, নামমাত্র অংশীদার, নিষ্ক্রিয় বা ঘুমন্ত অংশীদার, আপাতঃদৃষ্টিতে অংশীদার, কর্মী অংশীদার, আচরণ দ্বারা অনুমিত অংশীদার এবং প্রতিবন্ধ অংশীদার।

কোম্পানি বা কর্পোরেশন: এক অভিনব ও সর্বাধুনিক ব্যবসায় সংগঠন, যা সর্বাপেক্ষা আইনসৃষ্ট যৌথ মালিকানার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, এবং শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এটি চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী এবং নিজ নামেই এটি ব্যবসায়িক লেনদেন করে।
কোম্পানির গঠনপ্রণালী মূলত নিম্নলিখিত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. আইনানুগ সর্বনিম্ন সংখ্যক ব্যাক্তি পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
  2. কোম্পানীর প্রবর্তকগণ নিম্নোক্ত দুটি দলিল সংগ্রহ করেন বা প্রস্তুত করেন:
    স্মারকলিপি বা সংঘস্মারক বা পরিমেলবন্ধ ও পরিমেল নিয়মাবলী বা সংঘবিধি
  3. প্রবর্তকগণ এ পর্যায়ে দলিলপত্রাদি সংযোজনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের নির্ধারিত ফি প্রদানপূর্বক রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করেন ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য দলিলাদি সংযোজন করেন।
  4. শুধুমাত্র পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীর ক্ষেত্রে এপর্যায়ে কাজ আরম্ভ করার অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য প্রবর্তকগণ আরও কিছু দলিল নিবন্ধকের নিকট জমা দেন এবং কোম্পানীর বিবরণপত্র প্রস্তত করেন। নিবন্ধকের সন্তুষ্টিতে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগৃহীত হয়।
  5. কোম্পানী কাজ আরম্ভ করে।

কোম্পানির শ্রেণীবিভাগ
Company types

  1. সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি: বাংলাদেশে ১৮৪৪ সালে কোম্পানি আইন পাশ হওয়ার আগে তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের রাজার বা রাণীর বিশেষ ফরমান বা সনদবলে যে কোম্পানী গঠিত হতো তাকে সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি (Chartered Company) বলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, চার্টার্ড ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, চার্টার্ড মার্কেন্টাইল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এই ধরণের কোম্পানীর উদাহরণ। পরে অবশ্য বাংলাদেশে কোম্পানি আইন পাশ হওয়ার পর এধরণের কোম্পানি গঠনের সুযোগ রহিত করা হয়।
  2. সংবিধিবদ্ধ কোম্পানি: যেসকল কোম্পানি আইন পরিষদের বিশেষ আইন দ্বারা বা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে গঠিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদেরকে সংবিধিবদ্ধ কোম্পানি (Statutory Company) বলে। এসকল কোম্পানিকে সাধারণত একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং এদেরকে কোম্পানি আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়। এরা সাধারণত পরিবহণ, জলবিদ্যুৎ এবং সেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে গঠিত হয়। বাংলাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, বিআরটিএ, বিসিআইসি, ওয়াসা ইত্যাদি এধরণের প্রতিষ্ঠান।
  3. নিবন্ধিত কোম্পানি: রেজিস্ট্রিকৃত বা নিবন্ধিকৃত কোম্পানি (Registered Company) বলতে কোম্পানী আইনের অধীনে গঠিত ও নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়। নিবন্ধিত কোম্পানিকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় : অসীম দায় কোম্পানি ও সসীম দায় কোম্পানি।
    সসীম দায় কোম্পানি (যে সকল কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডারদের দায় সসীম) দুই প্রকার: প্রতিশ্রুত মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানী ও শেয়ার মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানী। শেয়ার মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানী দুই প্রকার:

    1. প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে সীমাবদ্ধ দায় কোম্পানিতে সদস্যের সংখ্যা ন্যূনতম ২ বা সর্বোচ্চ ৫০ জন রাখা হয় এবং সীমাবদ্ধ দায়ের ভিত্তিতে কোম্পানিকে প্রদত্ত আইনের আওতায় নিবন্ধিত করা হয়, তাকে ঘরোয়া মালিকানায় সীমাবদ্ধ কোম্পানি বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি (Private Limited Company) বলে।
    2. পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি: পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় কোম্পানি সংগঠন হলো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (Public Limited Company)। এসকল কোম্পানী বাজারে শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে মূলধন জোগাড় করে থাকে। বাংলাদেশে এধরণের কোম্পানির সদস্যসংখ্যা সর্বনিম্ন ৭ জন এবং সর্বোচ্চ শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে, শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য এবং কোম্পানি শেয়ার ও ঋণপত্র জনগণের উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের আহবান জানায়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে মালিকানার ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করা যায়:
      i) সরকারি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি : কোনো কোম্পানির মালিকানা বা এর শেয়ার মালিকানার কমপক্ষে ৫১% শেয়ার যদি সরকারি মালিকানায় থাকে এবং এর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের হাতে থাকে, তবে তাকে সরকারি মালিকানায় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে।
      ii) বেসরকারি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি : কোনো কোম্পানীর শেয়ারের কিয়দংশ সরকার গ্রহণ করলে তাকে আধা-সরকারি কোম্পানি বলে। কোনো কোনো সময় সরকার শেয়ার মূলধনের শতকরা ৩০% বা ৪০% গ্রহণ করে। এতে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানার সংমিশ্রণ ঘটে বলে একে আধা-সরকারি কোম্পানি বলে।
      পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে আরো দুইভাগে ভাগ করা যায়:
      i) হোল্ডিং কোম্পানি : যদি কোনো কোম্পানি অন্য কোম্পানির ৫০% শেয়ারের বেশি শেয়ারের মালিক হয় বা মোট ভোটদান ক্ষমতার ৫০%-এর অতিরিক্ত ভোটদান ক্ষমতা ভোগ করে অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগ করার ক্ষমতার অধিকারী হয় তবে ঐ কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণশালী বা ধারক কোম্পানি বা হোল্ডিং কোম্পানি বলে।
      ii) >সাবসিডিয়ারি কোম্পানি: যে কোম্পানির ৫০%-এর বেশি শেয়ার বা ভোটদান ক্ষমতা অন্য কোম্পানির অধীনে চলে যায় সে কোম্পানিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে। মূলত হোল্ডিং কোম্পানি যেসকল কোম্পানির ৫০% শেয়ার ক্রয় করে তাদেরকেই সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা অধীন কোম্পানি বলে।
  4. অন্যান্য কোম্পানি: জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে কোনো অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জন করে তা জনকল্যাণ কাজে ব্যবহার করলে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে সরকার তার সন্তুষ্টিস্বাপেক্ষে সীমাবদ্ধ দায় কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধনের নির্দেশ দিতে পারে। একোম্পানির নামের শেষে ‘লিমিটেড’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয় না।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট ও স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।