ওয়াইফাই, ব্লুটুথ এবং ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রযুক্তি। ইদানিং প্রায় সব নতুন মডেলের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে ওয়াইফাই ও ব্লুটুথ ফাংশন দেওয়া থাকে। আমরা অনেকেই এগুলোর ব্যবহার জানি, আবার অনেকে ব্যবহার না করলেও নামের সাথে কমবেশি পরিচিত। বিশেষ করে ওয়াইফাই/ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ও ব্লুটুথ দুটোই তারবিহীন যোগাযোগের প্রযুক্তি হিসাবে কাজ করে। ওয়াইফাই ও ব্লুটুথের ব্যবহার, সুবিধা-অসুবিধা ও পার্থক্যের ব্যাপারে যারা বিভ্রান্ত তাঁদের বোঝার সুবিধার্থে এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
ব্লুটুথ কী ও কিভাবে কাজ করে
ব্লুটুথ হল স্বল্প দুরত্বের মধ্যে একাধিক ডিজিটাল ডিভাইসে তথ্য আদান-প্রদানের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী তারবিহীন প্রযুক্তি। ১৯৯৪ সালে RS-232 ডাটা ক্যাবলের বিকল্প হিসাবে টেলিকম জায়েন্ট এরিকসন এটি তৈরি করে। এই প্রযুক্তিকে এখন ২০ হাজারেরও বেশি কোম্পানী স্ট্যন্ড্যার্ড হিসাবে ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, দশম শতাব্দীতে রাজা Herald Blåtand ডেনমার্ক ও নরওয়ের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে সবাইকে একই রাজ্য ও রাজার শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। সেই ধারনার সাথে মিল রেখে এই প্রযুক্তির নাম রাখা হয় ব্লুটুথ (Bluetooth)।
ব্লুটুথে কম ক্ষমতার (2.45 GHz) বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে তথ্য পাঠানো হয়। তাই এটি খুব সামান্য বিদ্যুতে কাজ করতে পারে। ব্লুটুথ সাধারণত ১ থেকে ২০ মিটার দুরত্বের মধ্যে এক সাথে ৭টি ডিভাইসের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। ব্লুটুথ কমপিউটার, মোবাইল ফোন ও তারবিহীন হেডসেটের মধ্যে পারষ্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ব্লুটুথের সাথে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগের কোন সম্পর্ক নেই। কমপিউটারে আগে থেকে ব্লুটুথ অপশন না থাকলে Bluetooth USB adapter কিনে ইউএসবি পোর্টে সংযোগ দিয়েও কাজ চালানো যায়।
Bluetooth 4.0
ব্লুটুথের সাম্প্রথিক ভার্সন Bluetooth 4.0 নতুন জেনারেশনের প্রযুক্তি। বিশেষ করে খুবই কম বিদ্যুতে দ্রুত গতিতে যাতে দীর্ঘসময় কাজ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে একে উন্নত করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্লুটুথের কারণে যাতে ব্যাটারি চালিত ছোট ডিভাইসগুলোতে ব্যাটারি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে না যায় সেদিকে জোড় দেওয়া হয়েছে। Bluetooth 4.0 কে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সামান্য তারতম্য করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে: Bluetooth Smart Ready এবং Bluetooth Smart।
Bluetooth Smart Ready device কে “ডুয়েল মুড” বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এটি পুরানো ও নতুন উভয় ধরনের ব্লুটুথ ডিভাইসের সাথে কাজ করবে (backward-compatible)। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্যুতের সাহায্যে চলে এমন ডিভাইসে এটি উত্তম। Bluetooth Smart-কে “সিঙ্গেল মুড” বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এটি শুধু নতুন জেনারেশনের ব্লুটুথ ডিভাইসের (Bluetooth 4.0) সাথে কাজ করবে। Bluetooth Smart খুব বেশি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। খুব ছোট ব্যাটারিতে চলে (single coin-cell battery) এমন ধরনের ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য এটি সুবিধাজনক।। যেমন ধরা যাক, একজন রোগীর শরীরে heart rate sensor বসানো আছে। ঐ রোগীর হাতে আছে একটি আইফোন। এখন হার্ট রেট সেন্সর ও আইফোনে যদি Bluetooth Smart প্রযুক্তি থাকে তাহলে রোগীটি তাঁর আইফোনে হার্ট বিট রেট লাইভ দেখতে পাবে।
WLAN বা ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক কী ও কিভাবে কাজ করে
ওয়াইফাই সম্পর্কে জানার আগে WLAN বা ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। একটি সীমিত এলাকা অর্থাৎ একই ভবন, পাশাপাশি অবস্থিত ভবন অথবা একটি অফিস বা একটি এপার্টমেন্টে অবস্থিত কমপিউটারসমূহ, প্রিন্টার ও অন্য কোন বিশেষ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে তারের পরিবর্তে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে স্থাপিত আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থাকে ওয়ারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (WLAN) বলে।
উপরের ছবিটি একটি ব্রডব্যান্ড লাইন থেকে একাধিক কমপিউটারে ইন্টারনেট কানেকশনের একটি ওয়ারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক। এই ধরনের নেটওয়ার্কে প্রয়োজন একটি মডেম ও একটি ওয়ারলেস রাউটার। যে কোন কমপিউটারে ওয়্যারলেস এডাপটার অথবা ওয়্যারলেস কার্ড ইন্সটল থাকলে এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট কানেকশন শেয়ার করতে পারবে। উল্লেখ্য, ওয়্যারলেস রাউটারে সরাসরি তারের (cable) মাধ্যমেও কমপিউটার সংযুক্ত করার পোর্ট থাকে।
ওয়াইফাই কী ও কিভাবে কাজ করে
Wi-Fi (Wireless Fidelity) হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কের টার্ম বা ট্রেড মার্ক যেখানে ওয়াইফাই এলাইয়েন্স নামে একটি কমিটি কর্তৃক পরীক্ষীত ও অনুমোদিত হার্ডওয়্যার ও স্পেসিপিকেশন ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য বিভিন্ন কোম্পানীর ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের ডিভাইসরগুলি যাতে পরষ্পরের সাথে কাজ করতে পারে। এছাড়া নেটওযার্কটির কনফিগারেশনসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল বিষয়ের একটি স্ট্যান্ডার্ড মান নির্ধারণ করা। ব্যাবহারকারীদের জন্য সুবিধা হচ্ছে, যদি কারো মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে Wi-Fi এডাপটার থাকে, তবে এটি যে কোন Wi-Fi নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে পারবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি সব ওয়াইপাই নেটওয়ার্ক হচ্ছে ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক IEEE 802.11-এর পরিবারভুক্ত।, কিন্তু সব ওয়্যারলেস লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক ওয়াইপাই নেটওয়ার্কভুক্ত নয়।
একটি ওয়াইফাই রাউটারের এরিয়ার বাইরে নতুন এলাকায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ অনেকভাবে করা যায়। তবে সহজ হচ্ছে মূল ওয়াইফাই রাউটারের সাথে তার দিয়ে (Ethernet cable) আরেকটি ওয়াইফাই রাউটার সংযুক্ত করে নতুন এলাকায় স্থাপন করা।
একটি ওয়াইফাই রয়টার/একসেস পয়েন্ট/এন্টিনার মাধ্যমে কোন বিশেষ স্থানে যখন ওয়ারলেস ইন্টারনেট কানেকশনের সুবিধা প্রদান করা হয় তখন সেই স্থানকে Hot Spot বলা হয়। একাধিক একসেস পয়েন্ট/Wi-Fi Extender/এন্টিনার মাধ্যমে সৃষ্ট হটস্পটগুলোকে সমন্বয় করে যখন বড় এলাকা ভিত্তিক একটি ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক তৈরি হয় তখন সেই এলাকাকে Wi-Fi Zone বলা হয়।
ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ এন্টিনার মাধ্যমে পাঁচটি হটস্পটের সমন্বয়ে একটি ওয়াইফাই জোনের সৃষ্টি হয়েছে। আবাসিক এলাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে এইভাবে একই ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়। আবার একই এলাকায় একাধিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কও থাকতে পারে। ধরা যাক, একই ভবনের ৫ম তলায় এবং ৪র্থ তলায় ওয়াইফাই রাউটার আছে। এখন ৪র্থ তলার ল্যাপটপ/মোবাইল ফোন একই সাথে ৪র্থ ও ৫ম তলার দুইটি রাউটারকে খুঁজে নেবে। যেহেতু দুরত্ব খুব কম। এখন যেটিতে প্রবেশের অনুমতি অর্থাৎ পাসওয়ার্ড আগে থেকেই সেটিং আছে সেটিই ব্যবহার করবে। তাই নিরাপত্তার কারণে ওয়াইফাই রাউটারকে সবসময় পাসওয়ার্ড প্রোটেকটেড করা জরুরি। আবার কিছু কিছু পাবলিক এরিয়া আছে যেখানে পাসওয়ার্ডমুক্ত ওয়াইফাই রাখা হয়েছে যাতে যে কোন কেউ ব্যবহার করতে পারে।
ওয়াইফাই কনফিগারেশন
ইদানিং নতুন মডেলের অনেক ল্যাপটপে ওয়াইফাই কার্ড আগে থেকেই ইনস্টল করা থাকে। আর না থাকলে আলাদা ওয়াইফাই এডাপটার/কার্ড কিনতে পাওয়া যায়। কার্ডের সাথে ইনস্টল-কনফিগারেশনের নিয়ম লেখা থাকে। এটা তেমন কঠিন নয়, এডাপটার/কার্ড সংযুক্ত করে কমপিউটার অন করলে অটো-ডিটেক্ট হয়ে কনফিগারেশন উইনডোজ চলে আসে।
মোবাইল ব্রডব্যান্ড বনাম ওয়াইফাই হটস্পট
মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা সাধারণত মোবাইল ফোনের কোম্পানীগুলো দিয়ে থাকে। সুতরাং প্রায় সব জায়গা থেকে (মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক) মোবাইল ফোন বা ওয়ারলেস মডেমের সাহায্যে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়া যায়। ওয়াইফাই হটস্পটে এই সুযোগ একটি সীমিত এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সুবিধা হচ্ছে, একটি মাত্র ইন্টারনেট লাইন থকে সৃষ্ট ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে অনেক লোক একসাথে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এতে খরচও কম, আবার প্রত্যেকে নিজের ফোন/ল্যাপটপ থেকে অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। ইদানীং বড় বড় শহরের বাস/ট্রেন স্টেশন, শপিং সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে ওয়াইফাই জোন সৃষ্টি করা হচ্ছে। মোবাইল ব্রডব্যান্ড সার্ভিসের মাসিক চার্জ বেশী। এছাড়া একদেশ থেকে অন্য দেশে গেলে মোবাইল ব্রডব্যান্ড সার্ভিস কাজ করে না, যদি কাজ করে তবে চার্জ হয় খুবই বেশী। তাই নিজস্ব ল্যাপটাপ বা মোবাইল ফোন থেকে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য ওয়াইফাই হটস্পট থেকে ইন্টারনেট কানেকশন সস্তা। ইদানিং বিভিন্ন শহরের ওয়াইফাই হটস্পটের তালিকা নেটে পাওয়া যায়।
এক নজরে ব্লুটুথ ও ওয়াইফাই-এর মধ্যে পার্থক্য | ||
ব্লুটুথ | ওয়াইফাই | |
কার্যকারিতা/বৈশিষ্ট্য: | স্বল্প দুরত্বে বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে তারবিহীন সংযোগের প্রযুক্তি | মুলতঃ ইন্টারনেটভিত্তিক তারবিহীন নেটওয়ার্কের প্রযুক্তি |
Development: | 1994 | 1991 |
Authority: | Bluetooth SIG | IEEE, WECA |
Version: | Bluetooth 2.0, 2.1, 3.0 and 4.0. | WiFi 802.11.a, 802.11.b … 802.11ax |
Frequency: | 2.4 GHz | 2.4, 3.6, 5 GHz |
Data Transfer: | 3 Mbps – 25 Mbps | 11 Mbps – 250 Mbps |
Range: | 5-30 meters | 30 -100 meters |
Security | It is less secure | It is more secure |
Electricity | Low consumption | High consumption |
Ease of Use | Fairly simple to use. | It is more complex and requires configuration of hardware and software. |
Primary Devices | Mobile phones, mouse, keyboards, office and industrial automation devices. | Notebook computers, desktop computers, servers, TV, Latest mobiles. |
Device Connected: | Upto 7 devices can be connected to each other | Maximum Connections depend on Wi-Fi router which can accommodate 1 to several communicating devices at a time. |
Wi-Fi Direct ও Bluetooth 4.0
ওয়াইফাই অ্যালাইয়েন্সের নতুন সংযোজন হচ্ছে ওয়াইফাই ডাইরেক্ট। এটি হচ্ছে ব্লুটুথের বিকল্প। অর্থাৎ পাশাপাশি একাধিক ডিভাইস (স্মার্ট ফোন, টিভি, ল্যাপটপ, কমপিউটার) তার ছাড়া তথ্য/ডাটা আদান-প্রদান করতে পারবে। এখানে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, রাউটার, একসেস পয়েন্ট ইত্যাদির প্রয়োজন নেই। কার্যক্ষমতা, গতি ও রেঞ্জের দিক দিয়ে Wi-Fi Direct ব্লুটুথের নতুন ভার্সন Bluetooth 4.0 থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
সূত্র: ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা